জীববিজ্ঞান আমাদের চারপাশের জীবনের রহস্য উন্মোচন করে। এই বিশাল ক্ষেত্রে, জীবকোষ ও টিস্যু হলো দুটি মৌলিক ধারণা যা প্রতিটি জীবিত প্রাণীর গঠন ও কার্যকারিতার ভিত্তি তৈরি করে। আপনি যদি জীবনের ক্ষুদ্রতম একক থেকে শুরু করে একটি সম্পূর্ণ জীবের গঠন প্রক্রিয়া বুঝতে চান, তবে জীবকোষ ও টিস্যু সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা অপরিহার্য।
কোষ কি?
জীবনের মৌলিক একক হলো কোষ। প্রতিটি জীব, সে এককোষী অ্যামিবা হোক বা বিশাল তিমি, কোষ দ্বারা গঠিত। কোষ এতটাই ক্ষুদ্র যে খালি চোখে দেখা যায় না; এদের দেখতে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন হয়। প্রতিটি কোষে জীবনের সকল মৌলিক প্রক্রিয়া, যেমন—পুষ্টি গ্রহণ, বৃদ্ধি, প্রজনন এবং উদ্দীপনায় সাড়া দেওয়া সম্পন্ন হয়। আপনি যখন কোনো জীবন্ত বস্তুর কথা ভাবেন, তখন তার গঠনের মূলে থাকে এই কোষগুলো।
কোষের প্রকারভেদ
পৃথিবীতে অসংখ্য ধরনের জীব রয়েছে, আর তাদের কোষগুলোও বৈচিত্র্যপূর্ণ। তবে প্রধানত, কোষকে দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়:
- প্রোক্যারিওটিক কোষ: এই ধরনের কোষে সুসংগঠিত নিউক্লিয়াস থাকে না। এদের নিউক্লীয় বস্তু সাইটোপ্লাজমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। ব্যাকটেরিয়া এবং সায়ানোব্যাকটেরিয়া (নীলাভ সবুজ শৈবাল) হলো প্রোক্যারিওটিক কোষের উদাহরণ।
- ইউক্যারিওটিক কোষ: এই কোষে একটি সুসংগঠিত নিউক্লিয়াস থাকে, যা একটি ঝিল্লি দ্বারা আবৃত থাকে। উদ্ভিদ, প্রাণী, ছত্রাক এবং প্রোটোজোয়া—সকলেরই ইউক্যারিওটিক কোষ রয়েছে।
উদ্ভিদ কোষ
উদ্ভিদ কোষ হলো ইউক্যারিওটিক কোষের একটি বিশেষ প্রকার। এদের কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা প্রাণী কোষে দেখা যায় না। আপনি যখন একটি গাছের কথা ভাবেন, তখন তার দৃঢ়তা এবং সবুজ রঙের কারণ এই কোষগুলোর কিছু বিশেষ অংশ।
- কোষ প্রাচীর: উদ্ভিদ কোষের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো কোষ ঝিল্লির বাইরে একটি দৃঢ় কোষ প্রাচীরের উপস্থিতি। এটি সেলুলোজ দ্বারা গঠিত এবং কোষকে নির্দিষ্ট আকার ও দৃঢ়তা প্রদান করে। এটি কোষকে অতিরিক্ত পানি গ্রহণ থেকে ফেটে যাওয়া থেকেও রক্ষা করে।
- ক্লোরোপ্লাস্ট: এই অঙ্গাণুগুলোতে ক্লোরোফিল থাকে, যা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় সূর্যরশ্মিকে খাদ্য শক্তিতে রূপান্তরিত করে। এ কারণেই উদ্ভিদ নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করতে পারে এবং সবুজ দেখায়।
- বৃহৎ কেন্দ্রীয় গহ্বর: উদ্ভিদ কোষে একটি বড় কেন্দ্রীয় গহ্বর থাকে যা পানি, বর্জ্য পদার্থ এবং পুষ্টি উপাদান সংরক্ষণ করে। এটি কোষের অভ্যন্তরীণ চাপ বজায় রাখতেও সাহায্য করে।
প্রাণী কোষ
প্রাণী কোষও ইউক্যারিওটিক কোষের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকার। এদের গঠন উদ্ভিদ কোষ থেকে কিছুটা ভিন্ন। আপনি যখন নিজের শরীরের কথা ভাবেন, তখন আপনার প্রতিটি অঙ্গ এই প্রাণী কোষ দ্বারা গঠিত।
- কোষ প্রাচীরের অনুপস্থিতি: প্রাণী কোষে কোষ প্রাচীর থাকে না। এর পরিবর্তে, কোষ ঝিল্লিই কোষের বাইরের আবরণ।
- ক্লোরোপ্লাস্টের অনুপস্থিতি: প্রাণী কোষে ক্লোরোপ্লাস্ট থাকে না, তাই তারা সালোকসংশ্লেষণ করতে পারে না এবং খাদ্যের জন্য অন্য জীবের উপর নির্ভরশীল।
- ক্ষুদ্র বা অনুপস্থিত গহ্বর: প্রাণী কোষে সাধারণত ছোট ছোট গহ্বর থাকে, অথবা কোনো গহ্বর নাও থাকতে পারে। যদি থাকে, তবে তা উদ্ভিদ কোষের মতো বড় হয় না।
- সেন্ট্রোসোম: প্রাণী কোষে সেন্ট্রোসোম নামক একটি অঙ্গাণু থাকে, যা কোষ বিভাজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদ্ভিদ কোষে সাধারণত সেন্ট্রোসোম থাকে না।
কোষ প্রাচীর
কোষ প্রাচীর হলো উদ্ভিদ, ছত্রাক, শৈবাল এবং কিছু ব্যাকটেরিয়া কোষে বিদ্যমান একটি অনমনীয়, প্রতিরক্ষামূলক স্তর। এটি কোষ ঝিল্লির বাইরে অবস্থিত। এর প্রধান কাজ হলো কোষকে নির্দিষ্ট আকার প্রদান করা, যান্ত্রিক চাপ থেকে রক্ষা করা এবং কোষের অভ্যন্তরে অত্যধিক পানি প্রবেশ প্রতিরোধ করা। উদ্ভিদ কোষে এটি মূলত সেলুলোজ দিয়ে তৈরি, যা একে দৃঢ়তা প্রদান করে। এটি কোষের জন্য একটি ফিল্টার হিসেবেও কাজ করে, কিছু নির্দিষ্ট অণু প্রবেশে বাধা দেয়।
কোষ ঝিল্লি
কোষ ঝিল্লি, যা প্লাজমা মেমব্রেন নামেও পরিচিত, প্রতিটি কোষের বাইরের আবরণ। এটি একটি অর্ধ-ভেদ্য ঝিল্লি যা লিপিড এবং প্রোটিন দ্বারা গঠিত। কোষ ঝিল্লির প্রধান কাজ হলো কোষের অভ্যন্তরীণ পরিবেশকে বাইরের পরিবেশ থেকে আলাদা করা এবং কোষের মধ্যে ও বাইরে পদার্থের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা। এটি একটি ‘নির্বাচনী প্রবেশদ্বার’ হিসেবে কাজ করে, যা কেবল নির্দিষ্ট অণুকে কোষে প্রবেশ করতে বা কোষ থেকে বের হতে দেয়। আপনি যখন কোষের ভেতরের এবং বাইরের পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার কথা ভাবেন, তখন কোষ ঝিল্লিই সেই কাজটি করে।
কোষের অঙ্গাণু
কোষের অভ্যন্তরে বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করার জন্য ছোট ছোট কাঠামো থাকে, যাদের কোষের অঙ্গাণু বলে। প্রতিটি অঙ্গাণুর নির্দিষ্ট কাজ রয়েছে যা কোষের সামগ্রিক কার্যকারিতার জন্য অপরিহার্য। কিছু গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গাণু হলো:
- মাইটোকন্ড্রিয়া: এটি কোষের ‘শক্তিঘর’ নামে পরিচিত। এখানে শসন প্রক্রিয়ায় খাদ্য থেকে শক্তি উৎপন্ন হয়, যা কোষের বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়।
- এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম (ER): এটি একটি জালিকাকার কাঠামো যা প্রোটিন এবং লিপিড সংশ্লেষণ ও পরিবহনে সাহায্য করে।
- রাইবোসোম: এগুলি প্রোটিন সংশ্লেষণের স্থান।
- গলজি বডি: এটি প্রোটিন এবং লিপিডকে প্রক্রিয়াজাত করে, প্যাকেজ করে এবং কোষের বিভিন্ন স্থানে বা কোষের বাইরে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করে।
- লাইসোসোম: এগুলি কোষের ‘পাচক থলি’ নামে পরিচিত। এরা বর্জ্য পদার্থ এবং ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গাণু ভেঙে ফেলে।
নিউক্লিয়াস
নিউক্লিয়াস হলো ইউক্যারিওটিক কোষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গাণু। এটি সাধারণত কোষের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং একটি ঝিল্লি দ্বারা আবৃত থাকে। নিউক্লিয়াসকে কোষের ‘নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র’ বলা হয়, কারণ এটি কোষের সমস্ত কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে।
- ক্রোমোসোম: নিউক্লিয়াসের ভিতরে ক্রোমোসোম থাকে, যা ডিএনএ (DNA) দ্বারা গঠিত। ডিএনএ হলো বংশগত তথ্যের ধারক, যা জীবের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে এবং এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে স্থানান্তরিত হয়।
- নিউক্লিওলাস: নিউক্লিয়াসের অভ্যন্তরে একটি ঘন অংশ থাকে যাকে নিউক্লিওলাস বলে। এটি রাইবোসোম গঠনের স্থান।
কোষ বিভাজন
একটি জীবদেহ বৃদ্ধি পায়, ক্ষতিগ্রস্ত কোষ মেরামত করে এবং প্রজনন করে কোষ বিভাজনের মাধ্যমে। এটি একটি মৌলিক প্রক্রিয়া যেখানে একটি মাতৃকোষ থেকে দুটি বা ততোধিক অপত্য কোষের সৃষ্টি হয়। কোষ বিভাজন প্রধানত দুই প্রকারের:
- মাইটোসিস: এই প্রক্রিয়ায় একটি মাতৃকোষ থেকে দুটি অভিন্ন অপত্য কোষ তৈরি হয়। প্রতিটি অপত্য কোষে মাতৃকোষের সমান সংখ্যক ক্রোমোসোম থাকে। এটি জীবের বৃদ্ধি, ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যুর মেরামত এবং অযৌন প্রজননে গুরুত্বপূর্ণ।
- মিয়োসিস: এই প্রক্রিয়ায় একটি মাতৃকোষ থেকে চারটি অপত্য কোষ তৈরি হয়, যেখানে প্রতিটি অপত্য কোষে মাতৃকোষের ক্রোমোসোম সংখ্যার অর্ধেক থাকে। এটি যৌন প্রজননের জন্য অপরিহার্য, কারণ এটি গ্যামেট (শুক্রাণু ও ডিম্বাণু) উৎপাদনে সাহায্য করে।
টিস্যু কি?
একই উৎস থেকে উৎপন্ন, একই রকম গঠন বিশিষ্ট এবং একই ধরনের কাজ সম্পন্নকারী কোষগুচ্ছকে টিস্যু বলে। যখন আপনি একটি জীবের কোনো নির্দিষ্ট কার্যকারিতার কথা ভাবেন, যেমন—পেশীর সংকোচন বা সংবেদনশীলতা, তখন এর মূলে থাকে নির্দিষ্ট ধরনের টিস্যু। কোষগুলো এককভাবে কাজ করলেও, টিস্যু হিসেবে তারা আরও সুসংগঠিত এবং কার্যকরীভাবে কাজ করতে পারে।
টিস্যুর প্রকারভেদ
জীবদেহে বিভিন্ন ধরনের টিস্যু থাকে, যা তাদের গঠন ও কাজের ভিত্তিতে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। প্রধানত, টিস্যুকে উদ্ভিদ টিস্যু এবং প্রাণী টিস্যু—এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
উদ্ভিদ টিস্যু
উদ্ভিদদেহে বিভিন্ন ধরনের টিস্যু থাকে যা উদ্ভিদকে বৃদ্ধি, খাদ্য পরিবহন, সুরক্ষা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করতে সাহায্য করে। উদ্ভিদ টিস্যুকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়:
ভাজক টিস্যু (Meristematic Tissue): এই টিস্যুর কোষগুলো অবিরাম বিভাজিত হতে পারে। এরা উদ্ভিদের বৃদ্ধি অঞ্চলের ডগা, মূলের অগ্রভাগ এবং কান্ডের পাশে পাওয়া যায়। এগুলি উদ্ভিদের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
স্থায়ী টিস্যু (Permanent Tissue): এই টিস্যুর কোষগুলো সাধারণত বিভাজন ক্ষমতা হারিয়েছে এবং নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদনে বিশেষভাবে অভিযোজিত হয়েছে। স্থায়ী টিস্যু আবার তিন প্রকারের হতে পারে:
- সরল টিস্যু: এই টিস্যুগুলো একই ধরনের কোষ দিয়ে গঠিত।
- প্যারেনকাইমা: উদ্ভিদের সবচেয়ে সাধারণ টিস্যু। এরা খাদ্য সঞ্চয়, সালোকসংশ্লেষণ এবং বর্জ্য পদার্থ সংরক্ষণে সাহায্য করে।
- কোলেঙ্কিমা: উদ্ভিদের তরুণ অংশে যান্ত্রিক সহায়তা প্রদান করে।
- স্ক্লেরেনকাইমা: উদ্ভিদকে দৃঢ়তা ও শক্তি প্রদান করে। এদের কোষ প্রাচীর খুব পুরু হয়।
- জটিল টিস্যু: এই টিস্যুগুলো একাধিক প্রকারের কোষ দিয়ে গঠিত এবং সম্মিলিতভাবে একটি নির্দিষ্ট কাজ করে।
- জাইলেম: এটি মূল থেকে পানি ও খনিজ লবণ উদ্ভিদের অন্যান্য অংশে পরিবহন করে।
- ফ্লোয়েম: এটি পাতা থেকে তৈরি খাদ্য উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশে পরিবহন করে।
- সরল টিস্যু: এই টিস্যুগুলো একই ধরনের কোষ দিয়ে গঠিত।
প্রাণী টিস্যু
প্রাণীদেহে চার ধরনের প্রধান টিস্যু থাকে, যা দেহের গঠন, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা এবং বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে।
- আবরণী টিস্যু (Epithelial Tissue): এই টিস্যু দেহের পৃষ্ঠকে আবরণ করে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভেতরের পৃষ্ঠকে আবৃত করে এবং গ্রন্থি গঠন করে। এটি সুরক্ষা, শোষণ, নিঃসরণ এবং সংবেদনে সাহায্য করে। যেমন—ত্বকের উপরের স্তর, পৌষ্টিকনালীর ভেতরের আস্তরণ।
- সংযোজক টিস্যু (Connective Tissue): এই টিস্যু বিভিন্ন অঙ্গ ও টিস্যুকে সংযুক্ত করে, সমর্থন প্রদান করে এবং দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে একসাথে ধরে রাখে। এদের মধ্যে কোষের সংখ্যা কম থাকে এবং কোষের বাইরে প্রচুর পরিমাণে ম্যাট্রিক্স থাকে। যেমন—রক্ত, অস্থি, তরুণাস্থি, চর্বি টিস্যু এবং তন্তুযুক্ত টিস্যু।
- পেশী টিস্যু (Muscular Tissue): এই টিস্যু সংকোচনশীল প্রোটিন দ্বারা গঠিত এবং নড়াচড়া ও চলাচলে সাহায্য করে। পেশী টিস্যু তিন প্রকারের হতে পারে:
- ঐচ্ছিক পেশী (Skeletal Muscle): আপনি আপনার ইচ্ছামতো এই পেশী নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, যেমন—হাঁটা বা হাত নাড়ানো।
- অনৈচ্ছিক পেশী (Smooth Muscle): এই পেশীগুলো আপনার ইচ্ছার অধীনে থাকে না, যেমন—পৌষ্টিকনালীর পেশী।
- হৃৎপেশী (Cardiac Muscle): এটি শুধুমাত্র হৃদপিণ্ডে পাওয়া যায় এবং অনৈচ্ছিকভাবে কাজ করে।
- স্নায়ু টিস্যু (Nervous Tissue): এই টিস্যু উদ্দীপনা গ্রহণ করে, প্রক্রিয়াজাত করে এবং দেহের বিভিন্ন অংশে সংকেত প্রেরণ করে। এটি মস্তিষ্ক, সুষুম্না কাণ্ড এবং স্নায়ু গঠন করে। স্নায়ু টিস্যুর মৌলিক একক হলো নিউরন।
কোষ ও টিস্যুর মধ্যে পার্থক্য
আপনি যখন জীবদেহের গঠন নিয়ে ভাবেন, তখন কোষ ও টিস্যু দুটি ভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিত্ব করে।
বৈশিষ্ট্যের ভিত্তি | কোষ | টিস্যু |
---|---|---|
সংজ্ঞা | জীবনের মৌলিক, গাঠনিক ও কার্যিক একক। | একই উৎস থেকে উৎপন্ন, একই রকম গঠন ও কাজ সম্পন্নকারী কোষগুচ্ছ। |
গঠন | এককভাবে গঠিত, বিভিন্ন অঙ্গাণু নিয়ে গঠিত। | একাধিক কোষের সমষ্টি। |
কার্যকারিতা | জীবনের সকল মৌলিক প্রক্রিয়া (পুষ্টি, শ্বসন, রেচন, প্রজনন) এককভাবে সম্পন্ন করতে পারে। | সুনির্দিষ্ট ও সম্মিলিত কাজ সম্পন্ন করে, যা একক কোষের পক্ষে সম্ভব নয়। |
স্তর | জীবদেহের সর্বনিম্ন গাঠনিক স্তর। | কোষের চেয়ে উচ্চতর গাঠনিক স্তর। |
উদাহরণ | স্নায়ুকোষ, রক্তকণিকা, পেশীকোষ। | স্নায়ু টিস্যু, রক্ত টিস্যু, পেশী টিস্যু। |
কী টেকঅ্যাওয়েজ
- কোষ: জীবনের মৌলিক একক, যা সমস্ত জীবের গঠন ও কার্যের ভিত্তি।
- কোষের প্রকারভেদ: প্রোক্যারিওটিক (সুসংগঠিত নিউক্লিয়াস নেই) এবং ইউক্যারিওটিক (সুসংগঠিত নিউক্লিয়াস আছে)।
- উদ্ভিদ কোষ: কোষ প্রাচীর, ক্লোরোপ্লাস্ট এবং বৃহৎ কেন্দ্রীয় গহ্বর থাকে।
- প্রাণী কোষ: কোষ প্রাচীর এবং ক্লোরোপ্লাস্ট থাকে না, সেন্ট্রোসোম থাকে।
- কোষ প্রাচীর: উদ্ভিদ কোষে দৃঢ়তা ও সুরক্ষা দেয়।
- কোষ ঝিল্লি: কোষের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করে এবং পদার্থের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে।
- কোষের অঙ্গাণু: মাইটোকন্ড্রিয়া (শক্তি উৎপাদন), নিউক্লিয়াস (নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র), রাইবোসোম (প্রোটিন সংশ্লেষণ) ইত্যাদি।
- নিউক্লিয়াস: কোষের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র, ডিএনএ ধারণ করে।
- কোষ বিভাজন: মাইটোসিস (বৃদ্ধি ও মেরামত) এবং মিয়োসিস (প্রজনন)।
- টিস্যু: একই গঠন ও কাজ সম্পন্নকারী কোষের সমষ্টি।
- উদ্ভিদ টিস্যু: ভাজক (বিভাজনক্ষম) এবং স্থায়ী (সরল ও জটিল)।
- প্রাণী টিস্যু: আবরণী (সুরক্ষা), সংযোজক (সংযুক্তকরণ), পেশী (চলাচল) এবং স্নায়ু (সংকেত পরিবহন)।
- পার্থক্য: কোষ হলো একক, টিস্যু হলো কোষের সমষ্টি যা সুনির্দিষ্ট কাজ করে।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)
প্রশ্ন: কোষ কেন জীবনের মৌলিক একক?
উত্তর: কোষকে জীবনের মৌলিক একক বলা হয় কারণ এটি জীবনের সকল মৌলিক প্রক্রিয়া, যেমন—পুষ্টি গ্রহণ, শক্তি উৎপাদন, বৃদ্ধি, প্রজনন এবং বর্জ্য নিষ্কাশন—এককভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম। কোনো জীবন্ত বস্তুর ক্ষুদ্রতম একক যা স্বাধীনভাবে জীবন ধারণ করতে পারে, তাই হলো কোষ।
প্রশ্ন: উদ্ভিদ কোষ ও প্রাণী কোষের মধ্যে প্রধান পার্থক্য কী?
উত্তর: প্রধান পার্থক্যগুলো হলো: উদ্ভিদ কোষে কোষ প্রাচীর, ক্লোরোপ্লাস্ট এবং একটি বৃহৎ কেন্দ্রীয় গহ্বর থাকে, যা প্রাণী কোষে থাকে না। প্রাণী কোষে সেন্ট্রোসোম থাকে, যা সাধারণত উদ্ভিদ কোষে অনুপস্থিত।
প্রশ্ন: টিস্যু কীভাবে গঠিত হয়?
উত্তর: টিস্যু একই উৎস থেকে উৎপন্ন, একই রকম গঠন বিশিষ্ট এবং একই ধরনের কাজ সম্পন্নকারী কোষের সমষ্টি দ্বারা গঠিত হয়। এই কোষগুলো একত্রিত হয়ে একটি নির্দিষ্ট কাজ আরও দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করে।
প্রশ্ন: নিউক্লিয়াসের কাজ কী?
উত্তর: নিউক্লিয়াসকে কোষের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বলা হয়। এটি কোষের সমস্ত কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং জীবের বংশগত তথ্য (ডিএনএ) ধারণ করে। এটি প্রোটিন সংশ্লেষণ এবং কোষ বিভাজন সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ায় নির্দেশ প্রদান করে।
প্রশ্ন: কোষ বিভাজন কত প্রকার ও কেন গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তর: কোষ বিভাজন প্রধানত দুই প্রকার: মাইটোসিস এবং মিয়োসিস। মাইটোসিস জীবের বৃদ্ধি, ক্ষতিগ্রস্ত কোষের মেরামত এবং অযৌন প্রজননের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মিয়োসিস যৌন প্রজননের জন্য অত্যাবশ্যক, কারণ এটি গ্যামেট (শুক্রাণু ও ডিম্বাণু) উৎপাদনে সাহায্য করে এবং প্রজাতির মধ্যে জিনগত বৈচিত্র্য বজায় রাখে।
প্রশ্ন: জাইলেম ও ফ্লোয়েমের কাজ কী?
উত্তর: জাইলেম এবং ফ্লোয়েম উভয়ই উদ্ভিদের জটিল স্থায়ী টিস্যু। জাইলেম মূল থেকে পানি ও খনিজ লবণ উদ্ভিদের অন্যান্য অংশে পরিবহন করে। অন্যদিকে, ফ্লোয়েম পাতা থেকে সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে তৈরি খাদ্য উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশে পরিবহন করে।
এই আলোচনা আপনাকে জীবকোষ ও টিস্যু সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা দিয়েছে আশা করি। এই মৌলিক ধারণাগুলো জীববিজ্ঞানের আরও গভীর বিষয়গুলো বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।