বায়োলজি চ্যাপ্টার ৪ – জীবনীশক্তি

জীবনীশক্তি: প্রকৃতির এক বিস্ময়কর খেলা!

আরে, কেমন আছেন সবাই? আজ আমরা এমন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলবো, যা ছাড়া আমাদের এই পৃথিবী, এই জীবন অচল। ভাবছেন কী সেটা? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন – জীবনীশক্তি! এই যে আমরা হাঁটাচলা করছি, কথা বলছি, গাছপালা বড় হচ্ছে, সূর্যের আলো থেকে খাদ্য তৈরি হচ্ছে – এর পেছনে একটাই রহস্য, আর তা হলো জীবনীশক্তি। চলুন, আজ আমরা এই জীবনীশক্তির গভীরে ডুব দিই, এর প্রতিটি পর্যায়কে বুঝি আর দেখি কীভাবে প্রকৃতি এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের জীবনকে সচল রেখেছে।

জীবনীশক্তি কী?

সহজ কথায়, জীবনীশক্তি হলো জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি। আমাদের শরীর বা যেকোনো জীবের শরীর যে কাজগুলো করে, সেগুলোর জন্য জ্বালানি প্রয়োজন। এই জ্বালানিই হলো জীবনীশক্তি। এটা ছাড়া কোনো জীবই তার মৌলিক কাজগুলো করতে পারবে না, যেমন – বৃদ্ধি, প্রজনন, চলাচল, এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাসও না।

জীবনীশক্তির সংজ্ঞা:

জীবনীশক্তি হলো সেই শক্তি, যা জীবদেহের যাবতীয় জৈবিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া, যেমন – বৃদ্ধি, বিকাশ, প্রজনন, চলাচল, পুষ্টি গ্রহণ, বর্জ্য নিষ্কাশন ইত্যাদি সম্পাদনের জন্য অপরিহার্য। এটি মূলত রাসায়নিক শক্তি রূপে কোষে সঞ্চিত থাকে এবং প্রয়োজনে বিভিন্ন রূপে রূপান্তরিত হয়।

জীবনীশক্তির বৈশিষ্ট্য:

  • রূপান্তরযোগ্য: জীবনীশক্তি এক রূপ থেকে অন্য রূপে রূপান্তরিত হতে পারে। যেমন, আলোক শক্তি সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
  • সঞ্চয়যোগ্য: জীবদেহ শক্তিকে ATP (অ্যাডেনোসিন ট্রাইফসফেট) নামক অণুর মধ্যে রাসায়নিক শক্তি হিসেবে সঞ্চয় করে রাখে।
  • প্রবাহমান: শক্তি একটি নির্দিষ্ট দিকে প্রবাহিত হয়, সাধারণত উচ্চ শক্তি স্তর থেকে নিম্ন শক্তি স্তরের দিকে। বাস্তুতন্ত্রে শক্তি সূর্য থেকে উৎপাদক, তারপর বিভিন্ন স্তরের খাদকদের মধ্যে প্রবাহিত হয়।
  • পুনর্ব্যবহারযোগ্য নয়: শক্তি একবার ব্যবহৃত হলে তা সম্পূর্ণরূপে পুনর্ব্যবহার করা যায় না। কিছু শক্তি তাপ শক্তি হিসেবে পরিবেশে হারিয়ে যায়।
  • জীবদেহের সকল কাজের চালিকাশক্তি: প্রতিটি জৈবিক প্রক্রিয়া, তা সে কোষ বিভাজনই হোক বা পেশি সংকোচন, শক্তির উপর নির্ভরশীল।

জীবনীশক্তির প্রকারভেদ:

জীবনীশক্তিকে মূলত এর উৎস এবং ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে বিভিন্নভাবে ভাগ করা যায়। যেমন:

  • রাসায়নিক শক্তি: জীবদেহে ATP, গ্লুকোজ ইত্যাদির মধ্যে যে শক্তি জমা থাকে।
  • তাপ শক্তি: জীবদেহের বিপাকীয় ক্রিয়ায় উৎপন্ন তাপ।
  • আলোক শক্তি: সালোকসংশ্লেষণের জন্য সূর্যের আলো থেকে প্রাপ্ত শক্তি।
  • যান্ত্রিক শক্তি: পেশি সংকোচনের ফলে উৎপন্ন শক্তি।
  • বিদ্যুৎ শক্তি: স্নায়বিক উদ্দীপনা পরিবহনে ব্যবহৃত শক্তি।

শক্তির উৎস:

আমাদের পৃথিবীর প্রায় সব শক্তির মূল উৎস হলো সূর্য। সূর্যের আলোক শক্তিকে কাজে লাগিয়েই গাছপালা খাদ্য তৈরি করে, যা পরবর্তীতে অন্যান্য প্রাণীদের শক্তির যোগান দেয়। এছাড়াও কিছু কিছু জীব রাসায়নিক শক্তি (যেমন: কেমোসিন্থেসিস) থেকে শক্তি উৎপন্ন করে।

শক্তির রূপান্তর:

শক্তি কখনো সৃষ্টি বা ধ্বংস হয় না, কেবল এক রূপ থেকে অন্য রূপে রূপান্তরিত হয়। এটাই হলো শক্তির নিত্যতা সূত্র। যেমন:

  • আলোক শক্তি → রাসায়নিক শক্তি: সালোকসংশ্লেষণে সূর্যের আলো রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে গ্লুকোজ তৈরি করে।
  • রাসায়নিক শক্তি → যান্ত্রিক শক্তি: পেশি সংকোচনে পেশির রাসায়নিক শক্তি যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
  • রাসায়নিক শক্তি → তাপ শক্তি: আমাদের শরীর খাবার থেকে শক্তি নিয়ে যখন কাজ করে, তখন কিছু শক্তি তাপ হিসেবে পরিবেশে চলে যায়।
  • রাসায়নিক শক্তি → বিদ্যুৎ শক্তি: স্নায়ুকোষে বৈদ্যুতিক সংকেত পরিবহনে রাসায়নিক শক্তি বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।

শক্তির একক:

শক্তি পরিমাপের জন্য বিভিন্ন একক ব্যবহৃত হয়:

  • জুল (Joule): শক্তির আন্তর্জাতিক একক।
  • ক্যালোরি (Calorie): খাদ্যশক্তির পরিমাপে বহুল ব্যবহৃত। 1 ক্যালোরি = 4.184 জুল। (পুষ্টি বিজ্ঞানে কিলো ক্যালোরি বেশি ব্যবহৃত হয়, যা 1000 ক্যালোরির সমান)।
  • কিলোওয়াট-ঘণ্টা (kWh): বিদ্যুৎ শক্তি পরিমাপের একক।

কোষের জীবনীশক্তি:

আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষই এক একটি ছোট্ট কারখানা, যেখানে অবিরাম কাজ চলছে। এই কাজগুলো করার জন্য কোষের শক্তির প্রয়োজন হয়। এই শক্তি আসে মূলত ATP (অ্যাডেনোসিন ট্রাইফসফেট) নামক অণু থেকে, যাকে “কোষের শক্তির মুদ্রা” বলা হয়।

কোষ বিভাজন:

কোষ বিভাজন হলো জীবদেহের বৃদ্ধি, ক্ষয়পূরণ এবং প্রজননের জন্য অপরিহার্য একটি প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার জন্য প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হয়, যা ATP থেকে আসে।

কোষীয় অঙ্গাণু:

কোষের মধ্যে বিভিন্ন অঙ্গাণু থাকে, যারা শক্তির উৎপাদন ও ব্যবহারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে:

  • মাইটোকন্ড্রিয়া: “কোষের শক্তিঘর” নামে পরিচিত। এখানে শ্বসনের মাধ্যমে ATP উৎপন্ন হয়।
  • ক্লোরোপ্লাস্ট: উদ্ভিদের কোষে পাওয়া যায়। সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে আলোক শক্তিকে রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে।
  • রাইবোসোম: প্রোটিন সংশ্লেষণ করে, যার জন্য শক্তির প্রয়োজন হয়।

ATP উৎপাদন:

ATP প্রধানত দুটি প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন হয়:

  • সালোকসংশ্লেষণ: সূর্যের আলো ব্যবহার করে উদ্ভিদে ATP উৎপন্ন হয়।
  • শ্বসন: গ্লুকোজ বা অন্যান্য খাদ্য উপাদান ভেঙে ATP উৎপন্ন হয়।
See Also  10MS মেডিকেল এডমিশন কোর্স - ২০২৫ Promo Code

আলোর শোষণ:

সালোকসংশ্লেষণের প্রথম ধাপ হলো ক্লোরোফিল নামক রঞ্জক পদার্থ দ্বারা আলোক শোষণ। ক্লোরোফিল সূর্যের আলোর নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্য শোষণ করে এবং সেই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে রাসায়নিক বিক্রিয়া শুরু করে।

সালোকসংশ্লেষণ (Photosynthesis):

সালোকসংশ্লেষণ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে সবুজ উদ্ভিদ, শৈবাল এবং কিছু ব্যাকটেরিয়া সূর্যের আলোক শক্তি, কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) এবং পানি (H2O) ব্যবহার করে গ্লুকোজ (খাদ্য) এবং অক্সিজেন (O2) তৈরি করে। এটি পৃথিবীর সকল জীবের জন্য খাদ্যের মূল উৎস।

জীবনীশক্তি

সালোকসংশ্লেষণের সমীকরণ:

6CO2 + 6H2O + আলোক শক্তি → C6H12O6 (গ্লুকোজ) + 6O2

সালোকসংশ্লেষণের গুরুত্ব:

  • খাদ্য উৎপাদন: পৃথিবীর সকল জীবের খাদ্যের মূল উৎস।
  • অক্সিজেন উৎপাদন: বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের ভারসাম্য বজায় রাখে, যা সকল জীবের শ্বসনের জন্য অপরিহার্য।
  • কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ: বায়ুমণ্ডল থেকে অতিরিক্ত CO2 শোষণ করে গ্রিনহাউস প্রভাব কমাতে সাহায্য করে।
  • জ্বালানি উৎপাদন: জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, পেট্রোলিয়াম) কোটি কোটি বছর আগে সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে তৈরি হওয়া জীবের অবশেষ থেকে উৎপন্ন হয়েছে।

সালোকসংশ্লেষণের পর্যায়:

সালোকসংশ্লেষণ মূলত দুটি প্রধান পর্যায়ে সংঘটিত হয়:

  1. আলোক নির্ভর পর্যায় (Light-dependent reactions):

    • এই পর্যায়টি ক্লোরোপ্লাস্টের থাইলাকয়েড মেমব্রেনে ঘটে।
    • এই পর্যায়ে সূর্যের আলো সরাসরি প্রয়োজন হয়।
    • ক্লোরোফিল আলোক শক্তি শোষণ করে।
    • আলোক শক্তির সাহায্যে পানির অণু ভেঙে অক্সিজেন, প্রোটন (H+) এবং ইলেকট্রন তৈরি হয় (ফটোলিসিস)।
    • উৎপন্ন শক্তি ATP এবং NADPH (নিকোটিনামাইড অ্যাডেনিন ডাইনিউক্লিওটাইড ফসফেট – একটি শক্তি ধারক অণু) নামক শক্তি বাহক অণুতে রূপান্তরিত হয়।
  2. আলোক নিরপেক্ষ পর্যায় বা অন্ধকার পর্যায় (Light-independent reactions or Dark reactions / Calvin Cycle):

    • এই পর্যায়টি ক্লোরোপ্লাস্টের স্ট্রোমায় ঘটে।
    • এই পর্যায়ে আলোর সরাসরি প্রয়োজন হয় না, তবে আলোক নির্ভর পর্যায়ে উৎপন্ন ATP এবং NADPH ব্যবহৃত হয়।
    • বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) গৃহীত হয়।
    • ATP এবং NADPH এর শক্তি ব্যবহার করে CO2 কে গ্লুকোজে রূপান্তরিত করা হয়। এই প্রক্রিয়াটি ক্যালভিন চক্র নামে পরিচিত।

C3 গতিপথ (C3 Pathway):

অধিকাংশ উদ্ভিদ (প্রায় 85%) C3 গতিপথ অনুসরণ করে। এই উদ্ভিদের ক্ষেত্রে, ক্যালভিন চক্রে কার্বন ডাই অক্সাইড প্রথম যে স্থায়ী যৌগে রূপান্তরিত হয়, সেটি একটি 3-কার্বন বিশিষ্ট যৌগ, যার নাম 3-ফসফোগ্লিসারেট (3-PGA)। এই কারণে এদের C3 উদ্ভিদ বলা হয়। ধান, গম, আলু ইত্যাদি C3 উদ্ভিদের উদাহরণ।

C4 গতিপথ (C4 Pathway):

কিছু উদ্ভিদ, যেমন – ভুট্টা, আখ, জোয়ার ইত্যাদি, বিশেষ অভিযোজন দেখায় এবং C4 গতিপথ অনুসরণ করে। শুষ্ক ও উষ্ণ অঞ্চলে এই উদ্ভিদগুলো সালোকসংশ্লেষণের দক্ষতা বাড়াতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে। C4 উদ্ভিদের ক্ষেত্রে, কার্বন ডাই অক্সাইড প্রথমে একটি 4-কার্বন বিশিষ্ট যৌগ, অক্সালোঅ্যাসিটেট (OAA)-এ রূপান্তরিত হয়। এই উদ্ভিদগুলোতে ক্রাঞ্জ অ্যানাটমি (Kranz Anatomy) নামক বিশেষ ধরনের পাতার গঠন দেখা যায়, যা তাদের সালোকসংশ্লেষণে সাহায্য করে।

CAM পাথওয়ে (Crassulacean Acid Metabolism – CAM Pathway):

মরুভূমির উদ্ভিদ, যেমন – ক্যাকটাস, আনারস ইত্যাদি, জল সংরক্ষণের জন্য CAM পাথওয়ে ব্যবহার করে। এই উদ্ভিদগুলো দিনের বেলায় তাদের স্টোমাটা বন্ধ রাখে যাতে পানি না হারায়। রাতে স্টোমাটা খুলে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং তাকে ম্যালিক অ্যাসিডে রূপান্তরিত করে। দিনের বেলায় এই ম্যালিক অ্যাসিড ভেঙে CO2 মুক্ত হয় এবং ক্যালভিন চক্রে প্রবেশ করে।

শ্বসন (Respiration):

শ্বসন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে জীবকোষে সঞ্চিত খাদ্যবস্তু (যেমন: গ্লুকোজ) অক্সিজেনের উপস্থিতিতে বা অনুপস্থিতিতে জারিত হয়ে শক্তি (ATP) উৎপন্ন করে এবং কার্বন ডাই অক্সাইড ও পানি উৎপন্ন হয়। এটি সালোকসংশ্লেষণের বিপরীত প্রক্রিয়া।

শ্বসনের সমীকরণ (সবাত শ্বসন):

C6H12O6 (গ্লুকোজ) + 6O2 → 6CO2 + 6H2O + শক্তি (ATP)

শ্বসনের প্রকারভেদ:

শ্বসন প্রধানত দুই প্রকারের:

  1. সবাত শ্বসন (Aerobic Respiration):

    • অক্সিজেনের উপস্থিতিতে ঘটে।
    • খাদ্যবস্তুর সম্পূর্ণ জারণ ঘটে।
    • প্রচুর পরিমাণে শক্তি (প্রায় 30-32 অণু ATP) উৎপন্ন হয়।
    • উৎপন্ন পদার্থ: কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) এবং পানি (H2O)।
    • প্রাণী ও অধিকাংশ উদ্ভিদে দেখা যায়।
    • এটি তিনটি প্রধান ধাপে ঘটে: গ্লাইকোলাইসিস, ক্রেবস চক্র এবং ইলেকট্রন ট্রান্সপোর্ট চেইন।
  2. অবাত শ্বসন (Anaerobic Respiration):

    • অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে ঘটে।
    • খাদ্যবস্তুর অসম্পূর্ণ জারণ ঘটে।
    • কম পরিমাণে শক্তি (2 অণু ATP) উৎপন্ন হয়।
    • উৎপন্ন পদার্থ: অ্যালকোহল (ইস্ট), ল্যাকটিক অ্যাসিড (পেশিকোষ), বা অন্যান্য জৈব যৌগ এবং CO2।
    • কিছু ব্যাকটেরিয়া, ইস্ট, এবং অক্সিজেনের অভাবে আমাদের পেশিকোষে ঘটে।

গ্লাইকোলাইসিস (Glycolysis):

  • শ্বসনের প্রথম ধাপ।
  • কোষের সাইটোপ্লাজমে ঘটে।
  • অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় না।
  • 1 অণু গ্লুকোজ ভেঙে 2 অণু পাইরুভিক অ্যাসিড, 2 অণু ATP এবং 2 অণু NADH উৎপন্ন হয়।
  • এটি সবাত ও অবাত উভয় শ্বসনেরই সাধারণ ধাপ।
See Also  বায়োলজি চ্যাপ্টার ১২ - জীবের বংশগতি ও জৈব অভিব্যক্তি

ক্রেবস চক্র (Krebs Cycle / Citric Acid Cycle):

  • সবাত শ্বসনের দ্বিতীয় ধাপ।
  • মাইটোকন্ড্রিয়ার ম্যাট্রিক্সে ঘটে।
  • পাইরুভিক অ্যাসিড অ্যাসিটাইল CoA-তে রূপান্তরিত হয়ে ক্রেবস চক্রে প্রবেশ করে।
  • এই চক্রে, অ্যাসিটাইল CoA সম্পূর্ণরূপে জারিত হয়ে CO2, ATP, NADH এবং FADH2 (ফ্ল্যাভিন অ্যাডেনিন ডাইনিউক্লিওটাইড – আরেকটি শক্তি ধারক অণু) উৎপন্ন হয়।

ইলেকট্রন ট্রান্সপোর্ট চেইন (Electron Transport Chain – ETC):

  • সবাত শ্বসনের তৃতীয় ও শেষ ধাপ।
  • মাইটোকন্ড্রিয়ার ভেতরের মেমব্রেনে ঘটে।
  • গ্লাইকোলাইসিস ও ক্রেবস চক্রে উৎপন্ন NADH এবং FADH2 থেকে ইলেকট্রন মুক্ত হয়।
  • এই ইলেকট্রনগুলো একটি ইলেকট্রন পরিবহন শৃঙ্খলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় প্রচুর পরিমাণে ATP উৎপন্ন করে।
  • ইলেকট্রনগুলো শেষ পর্যন্ত অক্সিজেনের সাথে যুক্ত হয়ে পানি তৈরি করে। এই ধাপেই অধিকাংশ ATP উৎপন্ন হয়।

ফার্মেন্টেশন (Fermentation):

ফার্মেন্টেশন হলো অবাত শ্বসনের একটি বিশেষ রূপ, যেখানে অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে গ্লুকোজ আংশিকভাবে ভেঙে অ্যালকোহল, ল্যাকটিক অ্যাসিড বা অন্যান্য জৈব যৌগ উৎপন্ন হয়। যেমন:

  • অ্যালকোহল ফার্মেন্টেশন: ইস্টে ঘটে, যেখানে গ্লুকোজ ভেঙে ইথানল এবং CO2 তৈরি হয়। রুটি তৈরি, বিয়ার বা ওয়াইন উৎপাদনে এর ব্যবহার রয়েছে।
  • ল্যাকটিক অ্যাসিড ফার্মেন্টেশন: আমাদের পেশিকোষে অক্সিজেনের অভাবে এবং কিছু ব্যাকটেরিয়ায় ঘটে। গ্লুকোজ ভেঙে ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরি হয়। দই বা পনির তৈরিতে এর ব্যবহার রয়েছে।

শক্তি প্রবাহ (Energy Flow):

বাস্তুতন্ত্রে শক্তি একমুখীভাবে প্রবাহিত হয়। এর অর্থ হলো, শক্তি এক স্তর থেকে অন্য স্তরে স্থানান্তরিত হওয়ার সময় কিছু শক্তি তাপ হিসেবে হারিয়ে যায় এবং এটি পুনরায় ব্যবহার করা যায় না।

খাদ্য শৃঙ্খল (Food Chain):

খাদ্য শৃঙ্খল হলো একটি নির্দিষ্ট পথে শক্তি প্রবাহের প্রক্রিয়া, যেখানে একটি জীব অন্য জীবকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। যেমন: ঘাস → হরিণ → বাঘ।

খাদ্য জাল (Food Web):

খাদ্য জাল হলো একাধিক খাদ্য শৃঙ্খলের জটিল আন্তঃসম্পর্ক। বাস্তবে, একটি জীব একাধিক উৎস থেকে খাদ্য গ্রহণ করতে পারে এবং একাধিক জীবের খাদ্য হতে পারে, যা একটি জালের মতো সম্পর্ক তৈরি করে।

পুষ্টি স্তর (Trophic Levels):

খাদ্য শৃঙ্খলে প্রতিটি ধাপকে পুষ্টি স্তর বলা হয়।

  • উৎপাদক (Producers): প্রথম পুষ্টি স্তর। এরা সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে নিজেদের খাদ্য তৈরি করে (যেমন: গাছপালা)।
  • প্রাথমিক খাদক (Primary Consumers): দ্বিতীয় পুষ্টি স্তর। এরা উৎপাদকদের খায় (যেমন: তৃণভোজী প্রাণী – হরিণ)।
  • মাধ্যমিক খাদক (Secondary Consumers): তৃতীয় পুষ্টি স্তর। এরা প্রাথমিক খাদকদের খায় (যেমন: মাংসাশী প্রাণী – শিয়াল)।
  • প্রগৌণ খাদক (Tertiary Consumers): চতুর্থ পুষ্টি স্তর। এরা মাধ্যমিক খাদকদের খায় (যেমন: বাঘ)।
  • বিয়োজক (Decomposers): এরা মৃত জীবদেহ ও বর্জ্য পদার্থ ভেঙে পুষ্টি উপাদানকে পরিবেশে ফিরিয়ে দেয় (যেমন: ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক)।

বাস্তুতন্ত্রে শক্তির প্রবাহ:

বাস্তুতন্ত্রে শক্তির প্রবাহ শুরু হয় সূর্য থেকে। উৎপাদকরা সূর্যের আলোক শক্তিকে রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে। এই শক্তি খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে এক পুষ্টি স্তর থেকে অন্য পুষ্টি স্তরে প্রবাহিত হয়। প্রতিটি স্তরে শক্তির প্রায় 90% তাপ হিসেবে পরিবেশে হারিয়ে যায় এবং মাত্র 10% পরবর্তী স্তরে স্থানান্তরিত হয় (10% সূত্র)।

জীবনীশক্তির তাৎপর্য ও গুরুত্ব:

জীবনীশক্তি ছাড়া কোনো জীব বা বাস্তুতন্ত্রের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না।

  • জীবন ধারণ: সকল জৈবিক প্রক্রিয়া, যেমন – বৃদ্ধি, চলাচল, প্রজনন, বিপাক ক্রিয়া – শক্তির উপর নির্ভরশীল।
  • বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য: শক্তি প্রবাহের মাধ্যমেই বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় থাকে।
  • পরিবেশের রক্ষণাবেক্ষণ: সালোকসংশ্লেষণ কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং অক্সিজেন উৎপন্ন করে বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য বজায় রাখে।
  • খাদ্য নিরাপত্তা: কৃষি উৎপাদন এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সরাসরি শক্তি প্রবাহের সাথে সম্পর্কিত।

জীবনীশক্তির ব্যবহার:

  • শারীরিক কাজ: হাঁটা, দৌড়ানো, চিন্তা করা, খাদ্য হজম করা ইত্যাদি।
  • বৃদ্ধি ও বিকাশ: কোষ বিভাজন ও নতুন কোষ তৈরি।
  • তাপ উৎপাদন: দেহের তাপমাত্রা বজায় রাখা।
  • প্রজনন: বংশবৃদ্ধি।
  • মেরামত: ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু বা অঙ্গ মেরামত করা।

শক্তির অপচয়:

শক্তি এক রূপ থেকে অন্য রূপে রূপান্তরিত হওয়ার সময় কিছু শক্তি তাপ হিসেবে পরিবেশে হারিয়ে যায়। এই হারিয়ে যাওয়া শক্তিকে আর ব্যবহার করা যায় না, এটিই শক্তির অপচয়। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী, কোনো শক্তি রূপান্তরেই 100% দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব নয়।

শক্তির সংরক্ষণ:

যদিও শক্তি সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না, আমরা এর অপচয় কমাতে পারি এবং এর দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারি। যেমন:

  • পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির উৎস (সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি) ব্যবহার করা।
  • বিদ্যুতের অপচয় কমানো।
  • জ্বালানির দক্ষ ব্যবহার।

শক্তির উৎস ও ব্যবহার:

  • সূর্য: আলোক শক্তি, সৌর বিদ্যুৎ।
  • খাদ্য: রাসায়নিক শক্তি, দেহের বিপাক।
  • জীবাশ্ম জ্বালানি: রাসায়নিক শক্তি, বিদ্যুৎ উৎপাদন, যানবাহন।
  • বায়ু: যান্ত্রিক শক্তি, বায়ু বিদ্যুৎ।
  • পানি: যান্ত্রিক শক্তি, জলবিদ্যুৎ।
See Also  রাসায়নিক বন্ধন কাকে বলে | রাসায়ন অধ্যায় ৫: রাসায়নিক বন্ধন

কোষীয় শ্বসন প্রক্রিয়া:

এটিই আমরা উপরে বিস্তারিত আলোচনা করেছি (গ্লাইকোলাইসিস, ক্রেবস চক্র, ETC)।

cellular respiration process min

অণুজীবের শ্বসন:

বিভিন্ন অণুজীবের শ্বসন প্রক্রিয়া ভিন্ন হতে পারে। কিছু অণুজীব সবাত শ্বসন করে, আবার কিছু অবাত শ্বসন বা ফারমেন্টেশন করে। যেমন, ইস্ট অ্যালকোহল ফার্মেন্টেশন করে, আর কিছু ব্যাকটেরিয়া ল্যাকটিক অ্যাসিড ফার্মেন্টেশন করে।

উদ্ভিদের শ্বসন:

উদ্ভিদেরাও প্রাণীদের মতোই শ্বসন করে। দিনের বেলায় সালোকসংশ্লেষণ ও শ্বসন উভয়ই চলে, তবে সালোকসংশ্লেষণের হার শ্বসনের চেয়ে বেশি হওয়ায় অতিরিক্ত অক্সিজেন পরিবেশে মুক্ত হয়। রাতে সালোকসংশ্লেষণ বন্ধ থাকে, তাই উদ্ভিদ শুধু শ্বসন করে এবং অক্সিজেন গ্রহণ করে CO2 ত্যাগ করে।

প্রাণীর শ্বসন:

প্রাণীরা শ্বসনের মাধ্যমে খাদ্য থেকে শক্তি গ্রহণ করে। বিভিন্ন প্রাণীর শ্বাসতন্ত্র ভিন্ন হয়। যেমন, মানুষ ফুসফুসের মাধ্যমে শ্বাস নেয়, মাছ ফুলকার মাধ্যমে শ্বাস নেয়।

শক্তির একক ক্যালোরি:

1 ক্যালোরি হলো সেই পরিমাণ তাপ শক্তি, যা 1 গ্রাম পানির তাপমাত্রা 1 ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়াতে প্রয়োজন হয়। পুষ্টি বিজ্ঞানে, “ক্যালোরি” বলতে আসলে “কিলো ক্যালোরি” বোঝানো হয়, যা 1000 ক্যালোরির সমান।

শক্তির একক জুল:

শক্তির আন্তর্জাতিক একক হলো জুল। 1 জুল হলো 1 নিউটন বল প্রয়োগে 1 মিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে যে কাজ হয়, তার সমান। 1 ক্যালোরি = 4.184 জুল।

শক্তির একক কিলোওয়াট (kW):

কিলোওয়াট হলো ক্ষমতার একক, শক্তির একক নয়। ক্ষমতা হলো প্রতি একক সময়ে কাজের হার বা শক্তি স্থানান্তরের হার। 1 কিলোওয়াট = 1000 জুল/সেকেন্ড। বিদ্যুৎ বিলের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত কিলোওয়াট-ঘণ্টা (kWh) হলো শক্তির একক। 1 kWh = 3.6 মিলিয়ন জুল।

ATP এর গঠন:

ATP (অ্যাডেনোসিন ট্রাইফসফেট) একটি নিউক্লিওটাইড অণু, যা অ্যাডেনিন (একটি নাইট্রোজেনঘটিত ক্ষার), রাইবোজ (একটি 5-কার্বন শর্করা) এবং তিনটি ফসফেট গ্রুপ নিয়ে গঠিত। ফসফেট গ্রুপগুলোর মধ্যে উচ্চ শক্তি সম্পন্ন বন্ধন থাকে, যা ভেঙে গেলে প্রচুর শক্তি নির্গত হয়।

ATP এর কাজ:

ATP হলো কোষের প্রধান শক্তির উৎস বা “শক্তির মুদ্রা”। কোষের প্রায় সকল শক্তি-নির্ভর কাজে ATP ব্যবহৃত হয়:

  • পেশি সংকোচন
  • সক্রিয় পরিবহন
  • স্নায়ু উদ্দীপনা পরিবহন
  • প্রোটিন সংশ্লেষণ
  • কোষ বিভাজন
  • তাপ উৎপাদন

সালোকসংশ্লেষণের কৌশল:

সালোকসংশ্লেষণের কৌশলটি অত্যন্ত জটিল এবং সুসংগঠিত। এটি আলোক শোষণ থেকে শুরু করে CO2 কে গ্লুকোজে রূপান্তর পর্যন্ত বিভিন্ন উৎসেচক এবং প্রোটিনের সমন্বয়ে ঘটে। ক্লোরোপ্লাস্টের ভেতরের মেমব্রেন (থাইলাকয়েড) এবং স্ট্রোমা এই প্রক্রিয়ার মূল কেন্দ্র।

ক্লোরোপ্লাস্ট:

ক্লোরোপ্লাস্ট হলো উদ্ভিদের কোষে পাওয়া এক ধরনের অঙ্গাণু, যেখানে সালোকসংশ্লেষণ ঘটে। এর মধ্যে থাইলাকয়েড নামক চাকতির মতো গঠন থাকে, যা গ্রানাম তৈরি করে। থাইলাকয়েডের মেমব্রেনে ক্লোরোফিল এবং অন্যান্য রঞ্জক পদার্থ থাকে, যেখানে আলোক নির্ভর পর্যায় ঘটে। থাইলাকয়েডের চারপাশের তরল অংশকে স্ট্রোমা বলে, যেখানে আলোক নিরপেক্ষ পর্যায় ঘটে।

শ্বাসতন্ত্র (Respiratory System):

শ্বাসতন্ত্র হলো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের একটি সমষ্টি, যা শ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জীবদেহে অক্সিজেন গ্রহণ এবং কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগে সাহায্য করে। মানবদেহে এর মধ্যে নাক, গলা, শ্বাসনালী, ব্রংকাই এবং ফুসফুস অন্তর্ভুক্ত।

শ্বাস-প্রশ্বাস (Breathing):

শ্বাস-প্রশ্বাস হলো গ্যাস বিনিময়ের একটি যান্ত্রিক প্রক্রিয়া, যেখানে ফুসফুসের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডল থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করা হয় এবং কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করা হয়। এটি শ্বসনের একটি অংশ, তবে শ্বসন একটি কোষীয় প্রক্রিয়া, যা শক্তি উৎপন্ন করে।

মানবদেহে শ্বসন:

মানবদেহে শ্বসন একটি জটিল প্রক্রিয়া, যা ফুসফুসে গ্যাস বিনিময় (বাহ্যিক শ্বসন) এবং কোষের মাইটোকন্ড্রিয়ায় খাদ্য জারণের মাধ্যমে শক্তি উৎপাদন (অভ্যন্তরীণ বা কোষীয় শ্বসন) উভয়ই অন্তর্ভুক্ত করে।

শক্তির রূপান্তর উদাহরণ:

energy conversion examples min
  • বৈদ্যুতিক পাখা: বিদ্যুৎ শক্তি → যান্ত্রিক শক্তি + তাপ শক্তি
  • মোমবাতি: রাসায়নিক শক্তি (মোম) → আলোক শক্তি + তাপ শক্তি
  • রেডিও: বিদ্যুৎ শক্তি → শব্দ শক্তি
  • সৌর প্যানেল: আলোক শক্তি → বিদ্যুৎ শক্তি
  • গাড়ি: রাসায়নিক শক্তি (জ্বালানি) → যান্ত্রিক শক্তি + তাপ শক্তি + শব্দ শক্তি

শক্তির প্রকারভেদ (বিস্তারিত):

  • রাসায়নিক শক্তি: অণুর বন্ধনে সঞ্চিত শক্তি। যেমন: খাদ্য, জ্বালানি।
  • তাপ শক্তি: অণুর গতিশক্তির কারণে উৎপন্ন শক্তি।
  • বিদ্যুৎ শক্তি: ইলেকট্রনের প্রবাহের কারণে উৎপন্ন শক্তি।
  • আলোক শক্তি: ফোটনের প্রবাহের কারণে উৎপন্ন শক্তি।
  • যান্ত্রিক শক্তি: গতিশক্তি (গতির কারণে) এবং বিভব শক্তি (অবস্থানের কারণে) এর সমষ্টি।
  • শব্দ শক্তি: কম্পনের কারণে উৎপন্ন শক্তি।
  • পারমাণবিক শক্তি: পরমাণুর নিউক্লিয়াসে সঞ্চিত শক্তি।

আশা করি, জীবনীশক্তির এই বিস্তৃত আলোচনা আপনার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। প্রকৃতিতে শক্তির এই খেলা সত্যিই অসাধারণ, তাই না? এই শক্তিই আমাদের জীবনকে সচল রেখেছে, আর আমাদের দায়িত্ব হলো এর সঠিক ব্যবহার করা এবং এর অপচয় রোধ করা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *